ফকির দুদ্দু সাঁই

আলোকচিত্র


ফকির লালন সাঁই এর গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রিয়তম শিশ্য দুদ্দু সাঁই লালনপন্থিদের মান্য মহাজন। ফকির দুদ্দু সাঁই এর জন্ম ১৮৪১ সালে। হরিশপুর সংলগ্ন বেলতলা গ্রামের ঝরু মণ্ডলের চার ছেলের মধ্যে দুদ্দু ছিলেন কনিষ্ঠ। তার নাম ছিল দবিরুদ্দিন। মেধাবী দুদ্দু গ্রামের পাঠশালা শেষ করে আরবি-ফারসি ভাষা এবং ইসলামি তত্ত্বের গ্যান অর্জন করেছিলেন। হরিশপুর গ্রামে বৈষ্ণব ধর্ম এবং সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার চর্চা ছিল। গ্রামের মদনলাল গোস্বামীর কাছে বাংলা ভাষা এবং বৈষ্ণব ধর্মের পাঠ নিয়েছিলেন দুদ্দু। বহু সংস্কৃত গ্রন্থ এবং চৈতন্য চরিতামৃত ছিল তার কন্ঠস্ত। হরিশপুরে পাঞ্জ, জহরুদ্দিন, কাসেম,পিজিরুদ্দিন , মদনলাল গোস্বামী, যদুনাথ সরকার, হারানচন্দ্র কর্মকার প্রভৃতি মুসলমান এবং হিন্দু সমাজভুক্ত সাধক-গায়ক ছিলেন। এঁদের সমাবেত আলোচনা এবং গানের অনুষ্ঠান হত সে কালে। গুরুর সন্ধানে নানা দেশ ঘুরে,অবশেষে লালন সাঁইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন। দীক্ষা গ্রহণের আগে দুদ্দু লালন সাঁই এর সঙ্গে প্রস্নোউত্তরি গান করতেন। গুরুর সঙ্গে ছেউড়িয়া আশ্রমে অনেকদিন তিনি একত্রবাস করেছিলেন। ফকির দুদ্দু সাঁই একমাত্র শিশ্য যে ফকির লালন সাইজির গানের প্রতিউত্তরে গান রচনা করেছেন। কথিত আছে লালন শাইজির গানকে সম্পূর্ণ জানতে হলে দুদ্দু সাঁই এর গান জানতে হবে। লালন শাইজির অন্যান্য শিস্যর মত দুদ্দু সাঁই সম্পর্কেও তার জীবিত থাকা সময়য়ের লিখিত কোন তথ্য উপাত্ত এখনো পাওয়া যায় নাই। বেলতলা নিজ গৃহে ফিরে আসেছিলেন দুদ্দু। এখানেই তার মৃত্যু হয় ১৯১১ সালে এবং সমাধি হয়। তার উত্তর পুরুষেরা দুদ্দুর কবরের চিহ্ন মুছে ফেলে সেখানে করেছিলো। নানা কল্পকাহিনী দিয়ে উত্তরপুরুষেরা মুছে দিতে চেয়েছে তার বাউল পরিচয়কে। দুদ্দুর প্রতিকৃতি, হাতে-লেখা গানের খাতা, গানের সুর কিছুই আর পাওয়া যায় না। কিন্তু তার পদাবলি বেঁচে আছে সাধক-গায়কদের স্মৃতিতে, শ্রুতিতে। এ পদাবলি রউদ্র-জলে মরে না- আয়ু তার দুরন্ত লোহার । লালন সাঁই এর গানে তত্ত্বদর্শন প্রায়শ প্রচ্ছন্ন ভাষা এবং ইশারা-ইঙ্গিতে আচ্ছাদিত থাকে। লালন সাঁই মূলত সাধক এবং প্রাগ্রসর সাধকদের জন্য পদ রচনা করেছেন। দুদ্দু আর এক পা এগিয়ে।শিক্ষিতজন এবং তত্ত্বজিজ্ঞাসুদের জন্য, মুনিদত্তের চর্যাপদের টীকার মতো, বাউল মতাদর্শের তুলনায় প্রাঞ্জলতর ব্যাখ্যা রচেছেন তার পদসুমুহে। এক দিকে দুদ্দু বাউল মতাদর্শের মূল সুত্র লিপিবদ্ধ করেছেন। অন্য দিকে বৌদ্ধ এবং বৈষ্ণব তান্ত্রিকতায়, করান এবং বেসরা সুফি ঐতিহ্যে বাউল সাধনাকে খুজেছেন। তাঁর পদে ভক্তির সঙ্গে তথ্য ও যুক্তির নিপুন সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। লালন সাঁই এর মতই তাঁর পদ গুলি সংযত ও সংহত। দুদ্দুর গান প্রাসাদগুনে পূর্ণ। আমরা একে অন্য নামে বলতে পারি ‘সহজবোধ্যতা’।অ- সাধক পাঠকদের জন্য তিনি সন্ধ্যাভাষার আচ্ছদান সরিয়ে, বাউল সাধনার বাস্তুভূমিকে মাঝে মাঝি উন্মোচন করেছেন।